কালো ছেলেরা কেন সুন্দরী স্ত্রী পায়: এক সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
![]() |
কালো ছেলেরা কেন সুন্দরী স্ত্রী পায়: এক সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ |
১. সৌন্দর্যের সামাজিক নির্মাণ
মানব সভ্যতার বিভিন্ন সময়ে “সৌন্দর্য” ধারণাটি বারবার রূপান্তরিত হয়েছে। একেক যুগে একেক ধরনের সৌন্দর্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। আমাদের উপমহাদেশে, ঔপনিবেশিক প্রভাব এবং বিজ্ঞাপন-ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থায় ফর্সা গাত্রবর্ণকে সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু এই “রঙের রাজনীতি” পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে একরকমভাবে কাজ করে না।
একাধিক সমাজবিজ্ঞানী যেমন Naomi Wolf (The Beauty Myth) এবং Pierre Bourdieu-এর থিওরি অনুসারে, নারীর রূপকে সমাজ তাদের “মূলধন” হিসেবে দেখে, কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুঁজি (সামাজিক মর্যাদা, সফলতা, শিক্ষা, আত্মবিশ্বাস ইত্যাদি)। ফলে একজন কালো পুরুষও যদি অন্য ক্ষেত্রে উজ্জ্বল হয়, তবে সে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় হয়।
২. আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্ব: আকর্ষণের আসল মূলধন
গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়েদের কাছে একজন পুরুষের আত্মবিশ্বাস, সামাজিক বুদ্ধিমত্তা এবং সামগ্রিক ক্যারিশমা রূপের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন কালো পুরুষ যেহেতু ছোটবেলা থেকেই রঙের কারণে সমাজে অবহেলার শিকার হয়, সে নিজের ভেতর কিছু বিশেষ গুণ তৈরি করে:
-
আত্মসম্মান গড়ার প্রবণতা
-
দায়িত্ববোধ ও মানসিক পরিপক্বতা
-
কঠোর পরিশ্রম ও আত্মনির্ভরশীলতা
-
মায়া ও সহানুভূতির প্রকাশ
এই সব গুণ একজন নারীকে নিরাপত্তা দেয়, যা সম্পর্ক গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. পারিবারিক নির্বাচন ও প্রোটেকশন থিওরি
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে এখনো অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের ক্ষেত্রে পরিবার বিশেষ করে মা-বোনেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক মা তাদের ছেলেকে “সফল কিন্তু সমাজে অবহেলিত” মনে করে। ফলে তারা সচেতনভাবেই একজন “সুন্দরী, শিক্ষিত ও মার্জিত” মেয়ে খুঁজে আনে। একে বলা যায় Protective Matrimonial Selection Bias।
এর মানে, পরিবারের নারী সদস্যরা মনে করে, ছেলেটি যেহেতু গায়ের রঙের কারণে অবহেলিত, তাই সে যেন দাম্পত্য জীবনে যেন কোনো কমতি অনুভব না করে—এই দায়বদ্ধতা থেকেই তারা মেয়ের রূপ-গুণের ক্ষেত্রে আপোষ না করে।
৪. মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
আজকাল চলচ্চিত্র, ওয়েব সিরিজ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কালো বা গাঢ় গাত্রবর্ণের পুরুষদেরকে সাহসী, শক্তিশালী, নায়কোচিত চরিত্রে উপস্থাপন করা হয়। বিশেষ করে আফ্রিকান-আমেরিকান সংস্কৃতিতে এই পরিবর্তন অনেকটা সামাজিক আন্দোলনের মতো শুরু হয়।
এই পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং নতুন প্রজন্মের মেয়েরা বুঝতে শেখে যে গায়ের রঙ নয়, চরিত্র ও মানসিকতা অনেক বড় বিষয়। ফলস্বরূপ, কালো ছেলেরাও সম্পর্কের বাজারে (relationship marketplace) প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উঠে আসে।
৫. বিয়ে কেবল রূপ নয়, ‘প্যাকেজ ডিল’
একজন সফল কালো পুরুষ তার পরিশ্রম, দক্ষতা ও যোগ্যতার মাধ্যমে নিজের “মার্কেট ভ্যালু” তৈরি করে। বিশেষ করে যদি তার:
-
নিজস্ব বাড়ি, গাড়ি বা স্ট্যাবল ক্যারিয়ার থাকে
-
পরিবারের প্রতি দায়িত্ববান হয়
-
মানসিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ হয়
-
স্ত্রীকে সম্মান ও ভালোবাসা দেয়
তাহলে সে স্বাভাবিকভাবেই অনেক মেয়ের কাছে কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে, যার মধ্যে “সুন্দরী মেয়েরাও” থাকে।
গায়ের রঙ কখনোই মানুষের যোগ্যতা, সম্ভাবনা বা ভালোবাসার অধিকার নির্ধারণ করতে পারে না। “কালো ছেলেরা সুন্দরী বউ পায়” — এই বাক্যটি যেন শুধুই ট্রল না থেকে যায়, বরং এটি হয়ে উঠুক সমাজের সৌন্দর্যবোধের একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি।
বস্তুত, প্রেম-ভালোবাসা ও বিবাহের ক্ষেত্রে একজন মানুষের মন, মানসিকতা ও মানবিক গুণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ যতই এগোচ্ছে, ততই রঙের বিভেদ হ্রাস পাচ্ছে—এটাই হোক আশাবাদের পথ।
তথ্যসূত্র (References):
-
Wolf, Naomi. The Beauty Myth. HarperCollins, 1991.
-
Bourdieu, Pierre. Distinction: A Social Critique of the Judgement of Taste.
-
Psychology Today: “What Women Really Want in a Partner”
-
BBC Future (2022): The Global Bias Toward Lighter Skin
-
Harvard Gender Studies Research (2020): Marriage Patterns in South Asia
Comments
Post a Comment