চীনের মহাপ্রাচীর কি সত্যিই মহাকাশ থেকে দেখা যায়?

চীনের মহাপ্রাচীর — মানুষের হাতে নির্মিত সবচেয়ে দীর্ঘ স্থাপত্য প্রকল্পগুলোর একটি, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ২১,০০০ কিলোমিটার। এটি এতটাই বিখ্যাত যে বহু মানুষ এখনো বিশ্বাস করে এটি হলো একমাত্র মানবসৃষ্ট বস্তু যা মহাকাশ থেকে দেখা যায়। 

কিন্তু প্রশ্ন হলো — এই দাবিটি কতটা সত্য? আদৌ কি মহাকাশে অবস্থানরত কোনো নভোচারী খালি চোখে এই প্রাচীর দেখতে পান?

চলুন, এক নজরে দেখে নেওয়া যাক এই জনপ্রিয় দাবি ও তার আশেপাশে থাকা বিতর্ক, তথ্য, ও মিথভঙ্গের ইতিহাস


মিথের জন্ম: বই থেকে মহাকাশ পর্যন্ত

এই দাবির সূত্রপাত ১৯৩৮ সালে। আমেরিকান লেখক ও অভিযাত্রী রিচার্ড হ্যালিবারটন তাঁর বই “Second Book of Marvels”-এ লিখেছিলেন: 

"জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন, চীনের মহাপ্রাচীর হচ্ছে একমাত্র মানবসৃষ্ট বস্তু যা চাঁদ থেকে দেখা যায়।"

এই বক্তব্য কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপর ভিত্তি করে নয়, বরং পুরোপুরি কল্পনা থেকে বলা হয়েছিল। কিন্তু এটা মানুষের মনে এমনভাবে গেঁথে যায় যে অনেক পাঠ্যবই, ডকুমেন্টারি, এমনকি শিক্ষক-গাইডরাও তা প্রচার করতে থাকেন।


নেইল আর্মস্ট্রং কী বলেছিলেন?

১৯৬৯ সালে চাঁদে অবতরণ করার পর নভোচারী নেইল আর্মস্ট্রং-এর কাছে অনেকেই জানতে চেয়েছিলেন:

“আপনি কি চাঁদ থেকে চীনের মহাপ্রাচীর দেখতে পেয়েছেন?”

তার স্পষ্ট উত্তর ছিল:

"আমি মনে করি না যে মহাপ্রাচীর চাঁদ থেকে দেখা যায়।"

এই বক্তব্য মিথটি ভাঙতে শুরু করে।


চীনা নভোচারীর বিস্ফোরক বক্তব্য

২০০৩ সালে, চীনের প্রথম নভোচারী ইয়াং লিউই যখন “শেনঝৌ ৫” নামক মহাকাশযানে মহাশূন্যে যান, তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়:

“আপনি কি মহাপ্রাচীর দেখতে পেয়েছেন?”

তাঁর জবাব:

"না, আমি মহাকাশ থেকে চীনের মহাপ্রাচীর দেখতে পাইনি।"

এই বক্তব্য চীনে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করে। কারণ, বহু বছর ধরে চীনা স্কুলের পাঠ্যবইয়ে লেখা ছিল যে মহাপ্রাচীর মহাকাশ থেকে দৃশ্যমান।

এরপর চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজ উদ্যোগে টেক্সটবুক থেকে এই মিথটি বাদ দেয়।


NASA-এর বক্তব্য ও বাস্তবতা

২০০৪ সালে, মার্কিন নভোচারী লিরয় চিয়াও আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) থেকে একটি ছবি তোলেন, যা কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন মহাপ্রাচীরের অংশ হতে পারে। তবে চিয়াও নিজেই স্বীকার করেন:

“আমি একটি টেলিফোটো লেন্স (জুম ক্যামেরা) ব্যবহার করেছি — খালি চোখে এটি দেখা যায় না।”

NASA একাধিকবার জানিয়েছে, মহাপ্রাচীর খালি চোখে দেখা "অত্যন্ত কঠিন", কারণ:

  • এটি সরু (প্রায় ৩০ ফুট),

  • এবং এটি প্রাকৃতিক ভূখণ্ডের সঙ্গে মিশে থাকে (রঙ ও টেক্সচারে মিল রয়েছে)।


কেন এই মিথ এতটা বিস্তৃত হলো?

এই ভুল ধারণা এত বছর ধরে টিকে থাকার পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে:

  • জাতীয় গর্ব: চীনের জন্য মহাপ্রাচীর একটি শক্তি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। মহাকাশ থেকে দৃশ্যমান এমন দাবি জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধি করে।

  • পাঠ্যবইয়ের ভুল তথ্য: একবার যদি কোনো তথ্য বইতে ছাপা হয়, তা প্রজন্মের পর প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে।

  • রোমাঞ্চকর ট্রিভিয়া: “একমাত্র মানবসৃষ্ট বস্তু যা মহাকাশ থেকে দেখা যায়” — এই ধরনের তথ্য মানুষ সহজে ভুলতে চায় না।


যেসব বিখ্যাত ব্যক্তি এই বিতর্কে যুক্ত ছিলেন

নাম অবদান
রিচার্ড হ্যালিবারটন ১৯৩৮ সালে প্রথম মিথ তৈরি
নেইল আর্মস্ট্রং চাঁদ থেকে না দেখার কথা বলেন
ইয়াং লিউই ২০০৩ সালে চীনা পাঠ্যবই সংশোধনে সহায়ক হন
লিরয় চিয়াও ২০০৪ সালে মহাকাশ থেকে ছবি তুলেন
NASA বহুবার স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছে

তাহলে শেষ কথা কী?

চাঁদ থেকে মহাপ্রাচীর দেখা যায়?
🔴 না। একেবারেই অসম্ভব।

নিচু মহাকাশ (Low Earth Orbit) থেকে দেখা যায়?
🟡 হতে পারে, তবে খালি চোখে দেখা প্রায় অসম্ভব। বিশেষ আলো, আবহাওয়া, অবস্থান ও যন্ত্রপাতির সাহায্যে কিছু অংশ শনাক্ত করা যেতে পারে।

সঠিক ভাষায় বলা যায়:

"চীনের মহাপ্রাচীর সাধারণ অবস্থায় খালি চোখে মহাকাশ থেকে দেখা যায় না।"


যেসব স্থাপনা মহাকাশ থেকে সহজে দেখা যায়

  • মিশরের পিরামিড

  • পাম জুমেইরাহ, দুবাই

  • ওয়াশিংটনের পেন্টাগন

  • বৃহৎ বিমানবন্দর ও রানওয়ে

  • থ্রি গর্জেস ড্যাম, চীন

এগুলি আকার, গঠন ও আলোর প্রতিফলনের কারণে বেশি দৃশ্যমান।

চীনের মহাপ্রাচীর বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর নির্মাণ — কিন্তু এটি মহাকাশ থেকে দৃশ্যমান কিনা, তা নিয়ে ছড়ানো মিথ এখন ভুল প্রমাণিত হয়েছে

মজার বিষয় হলো, এই সত্য জানার পরেও মহাপ্রাচীরের ঐতিহাসিক ও স্থাপত্য গৌরব একটুও কমে না। এটি এখনো ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ ও চমৎকার মানবসৃষ্ট স্থাপনা।


📚 তথ্যসূত্র:

  • NASA (nasa.gov)

  • রিচার্ড হ্যালিবারটন, Second Book of Marvels

  • ইয়াং লিউই-এর সাক্ষাৎকার (২০০৩)

  • লিরয় চিয়াওর ISS ফটো (২০০৪)

  • বিবিসি নিউজ আর্কাইভ


Parag Ferdus | habitablesolution.com

Comments